খ্যাতিমান সাংবাদিক আবেদ খানের জন্মদিন আজ। ১৯৪৫ সালে এই দিনে (১৬ এপ্রিল) তিনি খুলনা জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। অবিভক্ত ভারতের দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর নানা (মাতামহ)। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে আবেদ খানেরও সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ঘটে দৈনিক ‘জেহাদ’-এ। একই দৈনিকে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদ এবং ১৯৬৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে। সেই থেকে টানা ৯৪ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাকে থাকার পর চাকরি ছেড়ে সরাসরি ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশ আমলে অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টি-এর সূচনা হয় তাঁর হাতেই। তাঁর বিখ্যাত ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজ আজ পর্যন্ত এ দেশের সাংবাদিকতা জগতে অনুসন্ধানী রিপোর্টয়ের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে। ভোরের কাগজ -এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘টক অব দা টাউন’ কলামটি আবেদ খানকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ খান যে বিষয়েই লেখেন না কেন তাতে কখনই আদর্শিক বিবেচনাকে উপেক্ষা করেন না। তাঁর প্রতিটি লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানের কথা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমষ্টিগত উপস্থাপনার মধ্যেও। প্রচণ্ড আত্মসম্ভ্রমবোধ ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। এ সত্তেও মালিক কর্তৃপক্ষের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় পেয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে এক মুহুর্তও বিলম্ব করেননি। জীবিকার পরবর্তী নির্বাহ কিভাবে ঘটবে সেই চিন্তায় কখনো এতটুকু ব্যাকুল হননি।
১৯৭১-এর মার্চে তিনি ঢাকার নারিন্দা-ওয়ারী অঞ্চলে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ২৫ মার্চের কাল-রাতে ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানি-হানাদার বাহিনী
ইত্তেফাক ভবনে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলায় যখন মেতে উঠেছিল, আবেদ খান তখনও ইত্তেফাকে অবস্থান করছিলেন। ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। জুন মাসে সংবাদ, ডেইলি পিপল, ইত্তেফাক ভবন এবং সারা ঢাকার ওপর বয়ে চলা বিশ্ব-ইতিহাসের এই অতি-ভয়াল ধ্বংসলীলার চাক্ষুষসাক্ষী হিসেবে প্রথম তিনি কলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের
মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। একাত্তরে আকাশবাণী থেকে তিনি নিয়মিত যে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি করতেন তার নাম ‘জবাব দাও’। এরই মাঝে তিনি ৮ নং সেক্টরে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করান। মেজর ওসমান তখন সেক্টর আটের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মেজর মঞ্জুর এ সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবেদ খানের সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সফিকউল্লাহ। এ ছাড়াও জুন মাসে ১২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদ-এর পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন আবেদ খান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের আগস্টে ইত্তেফাকে তাঁর ধারাবাহিক অণুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘ওপেন সিক্রেট’ প্রকাশিত হতে থাকে। তৎকালীন সরকারের যেকোনো কর্মকাণ্ড বা ভূমিকার
ওপর এ সংক্রান্ত সিরিজ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ‘ওপেন সিক্রেট’-কে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের তদন্তমূলক সাংবাদিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ সংক্রান্ত পড়াশোনায়
‘রেফারেন্স’ হিসেবে ‘ওপেন সিক্রেট’-এর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এরপর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অভাজন ছদ্মনামে ‘নিবেদন ইতি’
শিরোনামে কলাম লেখায় হাত দেন। এই ‘নিবেদন ইতি’ও সেসময় অভাবিত জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৯৫ সালে আবেদ খান ইত্তেফাক থেকে অব্যাহতি নেন। কলামিস্ট হিসেবে সমসাময়িক সময়ে দেশের শীর্ষ দৈনিক জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ ও সংবাদ-এ মুক্তহাতে লিখতে থাকেন।
১৯৯৫ সাল থেকে জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় পাতায় তাঁর ‘অভাজনের নিবেদন’ প্রকাশের পাশাপাশি প্রথম পাতায় ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে।
‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান’ কলামটি জনকণ্ঠেই প্রকাশিত তাঁর স্যাটায়ার-ধর্মী জনপ্রিয় কলাম। দৈনিক ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় তাঁর ‘টক অব দ্য টাউন’ শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনটি সেসময় তুমুল জনপ্রিয়তায় দেশবাসীর কাছে হয়ে উঠেছিল যেন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। একই কাগজে এ সময় তাঁর উপসম্পাদকীয় কলাম ‘প্রাঙ্গণে বহিরাঙ্গণে’ প্রকাশ
হতে থাকে। দৈনিক সংবাদে তিনি ‘তৃতীয় নয়ন’ নামে একটি অন্তর্দৃষ্টি-বিশ্লেষণাত্মক কলাম ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন। এ সময় ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রবাসী সংস্করণ ‘প্রবাসী আনন্দবাজার’-এও নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে। প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এ সময় আবেদ খান নিজেই ক্রমশ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হয়ে উঠতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে নতুন দৈনিক প্রথম আলো-তে ‘কালের কণ্ঠ’ শিরোনামে তাঁর উপসম্পাদকীয় কলাম প্রকাশ হতে থাকে। পরে ২০০৯ সালে আবেদ খানের নেতৃত্বে কালের কণ্ঠ নামের দৈনিক পত্রিকাটি বাজারে আসে। ২০১১ সালের ৩০ জুন কালের কণ্ঠ থেকে পদত্যাগের পর তিনি ২০১২ সালের জুন মাসে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি এটিএন নিউজ থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক জাগরণ নামের প্রকাশিতব্য একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারে একটি স্যাটায়ার-ধর্মী টক-শো’র পাণ্ডুলিপি লিখতেন তিনি। তাঁর সেই হিউমার-সমৃদ্ধ টক-শো শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি আবেদ খান এ সময় থেকে ইলেকট্রনিক-মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেন ১৯৭৮ সালে। আবেদ খান ও ড. সানজিদা আখতার দম্পতির গ্রন্থনা-উপস্থাপনায় দম্পতি-বিষয়ক ধারাবাহিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘তুমি আর আমি’ প্রথম থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। দম্পতি-শিল্পীদের নিয়ে সঙ্গীত
বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘একই বৃন্তে’ সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৪, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে আবেদ খান-সানজিদা দম্পতি ঈদের ‘আনন্দমেলা’ নামের একটি
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও গ্রন্থনার ভূমিকা পালন করেন। যেসব গুণী মানুষের সংস্পর্শে ‘আনন্দমেলা’ ঈদ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয়তার চূড়া স্পর্শ করেছে তাঁদের মধ্যে এ দম্পতি অন্যতম। এ সময় থেকে টেলিভিশনের অসংখ্য টক-শো সঞ্চালনার মাধ্যমে তাঁরা জনপ্রিয় টেলিভিশন-ব্যক্তিত্বে পরিণত হন— যা এখনো সমানভাবে প্রবহমান। কিছুকাল
রেডিও-টেলিভিশন শিল্পী সংসদের প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন আবেদ খান।
১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি একুশে টেলিভিশনের সংবাদ ও চলতি তথ্য বিষয়ে প্রধান হিসেবে কাজ করেন। একুশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সংবাদ উপস্থাপনার উদাহরণ হিসেবে একুশে টেলিভিশনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রাথমিকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রযুক্তিগত অবকাঠামোতে অনেক বেশি সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও টেরেস্ট্রিয়াল ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন মিডিয়ায় আধুনিক সাংবাদিকতা এ দেশে তাঁর হাত ধরেই স্পর্শ করেছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার বিরল শিখর। এর আগে ১৯৯৬-৯৯ সালে তাঁর অনুসন্ধানমূলক টেলিভিশন রিপোর্টিং সিরিজ ‘ঘটনার আড়ালে’ টেলিভিশন-সাংবাদিকতার আরেকটি জনপ্রিয় চূড়া।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তিনি বরাবরই সোচ্চার। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন যোগ্যতার সঙ্গে। এবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ হয়েছে তাঁর গবেষণাধর্মী বই “ ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি। এখন পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। আজ এই গুণী ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে সংবাদ জগত ও জাতির পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।