চীন থেকে ছড়াতে শুরু করা করোনা ভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভয়াবহ এ ভাইরাস পৌঁছে গেছে বিশ্বের ১১৮টি দেশে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষ। এরমধ্যে মারা গেছেন ৪৬০০। বিশ্বের দেশগুলো এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এমন দেশগুলোর বিরুদ্ধে আরোপ করা হচ্ছে নানা বিধিনিষেধ। নাগরিকদের বিদেশ সফরে অনুৎসাহিত করছে সরকারগুলো। করোনা আতঙ্কে বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কয়েকটি জাতি।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, থেমে যাচ্ছে পর্যটন। ব্যাহত হচ্ছে সাংস্কৃতিক আয়োজন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরগুলো ও ব্যবসা-বাণিজ্য।
এমন বাস্তবতায় করোনা ভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান ড. টেডরস আধানম ঘেব্রিয়েসাস ঘোষণায় বলেন, গত দুই সপ্তাহে চীনের বাইরে করোনা সংক্রমণের ঘটনা বেড়েছে ১৩ গুণেরও বেশি। এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন বলে জানান তিনি। সংস্থাটির হিসাবে, যে রোগ একইসঙ্গে একাধিক দেশে সংক্রমিত হতে শুরু করে তাকে বিশ্ব মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত দুই সপ্তাহে এন্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। এ শতাব্দীর সব থেকে বড় অবরোধ চলছে ইউরোপে।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার থামাতে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী ৩০ দিন ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অবস্থাও ভয়াবহ। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১১০০ ছাড়িয়েছে, মারা গেছেন কমপক্ষে ৩৮ জন। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামেপর দাবি, করোনার বিস্তার রোধে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে ইউরোপ তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপের সবগুলো দেশ এ নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকলেও বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডকে এর বাইরে রাখা হয়েছে। যদিও বৃহসপতিবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৪৬০ বৃটিশ নাগরিক। নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানিয়ে ব্যবসায়ীদের কয়েক শত কোটি ডলার ঋণ দিতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ট্রামপ। বলেছেন তাদের আয়কর মওকুফের কথাও। দেশটির বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে করোনার প্রাদুর্ভাব। এরমধ্যে আছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এলার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউসি। তার দাবি, নাগরিকদের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এ ভাইরাস। করোনা আঘাত হেনেছে হলিউডেও। অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস ও তার স্ত্রী রিটা উইলসন অস্ট্রেলিয়া থেকে জানিয়েছেন যে, পরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে।
গত বছরের শেষদিকে চীনে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয়। এখন পর্যন্ত করোনা সব থেকে বেশি বিপর্যস্ত করেছে চীনকেই। এখন পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ৩১৬৯ জন। তবে চীন সরকারের প্রচেষ্টায় করোনা নিয়ন্ত্রণে এখন প্রায় পুরোপুরি সফল দেশটি। এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়িতে চলে গেছেন ৭০ হাজারের মতো। প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের দেশটিতে এখন প্রতিদিন নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক অঙ্কে নেমে এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে করোনার চিকিৎসায় খোলা নতুন হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ। বুধবার দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ৮ জন। এমন অবস্থায় আরোপিত বিধিনিষেধ সহজ করেছে চীন সরকার। খুলতে শুরু করেছে উহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তাঘাটে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। জনজীবন আবারো চঞ্চল হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
করোনা ভাইরাস বিস্তারের প্রথম ধাপে শুধু চীনে সংক্রমিত হলেও বাইরের দেশগুলোতে ছিল হাতেগোনা কয়েকটি কেস। তবে আস্তে আস্তে অবস্থা পাল্টে এখন চীনের বাইরেই ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করছে করোনার প্রাদুর্ভাব। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান ও ইউরোপের দেশ ইতালিতে এ ভাইরাস বিস্তারের নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বুধবার ইতালিতে একদিনেই মারা গেছেন ১৯৬ জন। সর্বমোট মারা গেছেন ৮ শতাধিক। অপরদিকে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ হাজার। পুরো দেশ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। জীবন বাঁচানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের অবস্থাও গুরুতর। সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সরকারি হিসেবে প্রায় সাড়ে চারশ’। এরমধ্যে আছেন দেশটির কয়েকজন আইনপ্রণেতাও। বিদেশি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, অবস্থা সেখানে আরো গুরুতর। তবে তথ্য গোপনের এমন দাবি অস্বীকার করেছে ইরান সরকার। চীনের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ কোরিয়ায়ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজারে। তবে সামপ্রতিক সময়ে দেশটি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এ ভাইরাসের বিস্তার।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশই এখন করোনা আক্রান্ত। দেশগুলো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান ও কুয়েতে সব থেকে বেশি করোনা আক্রান্ত হলেও অঞ্চলটির অন্য রাষ্ট্রগুলোতেও বেড়ে চলেছে সংক্রমণ। ফলে, নাগরিকদের বিদেশে চলাচলে বাধা-নিষেধ আরোপ করছে দেশগুলো। ইতিমধ্যে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে সৌদি আরব। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সুদান, কেনিয়া, জিবুতি ও সোমালিয়াসহ আরো বেশ কিছু দেশ থেকেও সৌদি আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাময়িক বাতিল করা হয়েছে বেশ কিছু দেশের ফ্লাইট। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২১ জন। সংক্রমণ থামাতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে একটি প্রদেশ। এ ছাড়া, বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
এদিকে করোনার বিস্তার রোধে বড় পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। আগামী ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত সব পর্যটন ভিসা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলাচলকারী ফ্লাইটগুলো বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের নিয়ে আসতে একটি বিমান চালু থাকবে। পর্যটন ভিসা বাতিল হলেও এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রয়েছে কূটনৈতিক ভিসা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, তাদের কর্মচারী ও প্রকল্পের অধীনে কর্মরতরা। চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত থাকলেও দেশটিতে করোনার বিস্তার হচ্ছে ইতালি, ইরান ও সেপন থেকে।