করোনার সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি স্বাগত। করোনাভাইরাসকান্ডে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে শিল্প তথা অর্থনীতির চাকা একেবারে বসে যাওয়া রুখতে এই প্রবল সঙ্কটের সময়ে সরকারকে অবিলম্বে ছোট-মাঝারি শিল্পের পাশে দাঁড়ানোর এই উদ্যোগকে স্বাগতম। এখন দরকার তাদের জন্যে ত্রাণ প্যাকেজেরও।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চালিকা শক্তি। অল্প বা মোটামুটি বিনিয়োগে অধিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এই খাত। বাংলাদেশের মতো বিপুল শ্রমশক্তির দেশে বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ এবং মোট শ্রমবাজারের ২৫ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানাগুলোতে। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মোট দেশজ উৎপাদনে আরও অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার হয়েও বিগত কয়েক বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প আমাদের দেশে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে শুরু করেছে। চাকরি না খুঁজে নিজের এবং অন্যের কর্মসংস্থান তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর আহ্বান অনেক মানুষের মানসিক গঠনে এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে উচ্চশিক্ষিত এমনকি বিদেশফেরত উচ্চশিক্ষিতদের অনেকেও নিজেদের দেশের শিল্পোন্নয়নে নিয়োজিত করেছেন। তাঁদের উদ্যোগ সাধারণত শুরু হয় ক্ষুদ্র অথবা মাঝারি শিল্প দিয়েই।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ-১ : ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রদান করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।
প্যাকেজ-২ : ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রদান করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।
প্যাকেজ-৩ : বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত ইডিএফ (Export Development Fund)-এর সুবিধা বাড়ানো : Back-to-back LC এর আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার LIBOR + ১ দশমিক ৫ শতাংশ (যা প্রকৃতপক্ষে ২ দশমিক ৭৩%) থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। প্যাকেজ-৪ : প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫ : এর আগে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
সবাইকে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সম্ভাব্য এই বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রপ্তানি খাতের পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমি সবাইকে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
সব শ্রেণির মানুষের জন্য ৪ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাৎক্ষণিক, স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি এ তিন পর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চারটি কার্যক্রম নিয়ে এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত চারটি কার্যক্রম হলো :
সরকারি ব্যয় : সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কর্মসৃজনকে’ মূলত প্রাধান্য দেওয়া হবে। বিদেশ ভ্রমণ এবং বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা হবে। আমাদের ঋণের স্থিতি-জিডিপির অনুপাত অত্যন্ত কম (৩৪%) বিধায় অধিকতর সরকারি ব্যয় সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করবে না।
আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ : ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ রাখাই হলো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।
সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি : দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে। এর আওতায় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হলো : বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ; ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয়; লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ; ‘বয়স্ক ভাতা’ এবং ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা; এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য যেসব বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তার একটি খতিয়ান প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরে বলেন, ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনের ফলে স্বল্পআয়ের মানুষ যেমন সংকটে পড়েছে, তেমনি সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তার, স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর সৃষ্ট বিপুল চাপ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে নজিরবিহীন লকডাউন ও যোগাযোগ স্থবিরতা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ইতিমধ্যেই ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি বাণিজ্য, সেবা খাত বিশেষত পর্যটন, এভিয়েশন ও হসপিটালিটি খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধস নেমেছে। শুধু সরবরাহ ক্ষেত্রেই নয়, চাহিদার ক্ষেত্রেও ভোগ ও বিনিয়োগ চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। আইএমএফ ইতিমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। পুঁজিবাজারে বিশ্বব্যাপী বিগত কয়েক সপ্তাহে ২৮-৩৪ শতাংশ দরপতন ঘটেছে।
OECD (Organisation for Economic Co-operation and Development)-এর হিসাব মতে, মন্দা প্রলম্বিত হলে বিশ্ব¦ প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের ফলে বিশ্বব্যাপী বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব এই প্রথম এমন মহামন্দা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কী ধরনের বা কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা এখনো নির্দিষ্ট করে বলার সময় আসেনি। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব তুলে ধরছি : তা হলো, আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থবছর শেষে এই হ্রাসের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলমান মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাংক সুদের হার হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সার্ভিস সেক্টর বিশেষত হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন এবং এভিয়েশন সেক্টরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা হ্রাসের কারণে এর মূল্য ৫০ শতাংশের অধিক হ্রাস পেয়েছে; যার বিরূপ প্রভাব পড়বে প্রবাসী-আয়ের ওপর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বন্ধ এবং পরিবহন সেবা ব্যাহত হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং সরবরাহ চেইনে সমস্যা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। এর ফলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবাইকে আন্তরি হয়ে কাজ করলে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে।
এই সময়ে সমস্যা অনেক তীব্র। এখনি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছে।
ব্যবসা তালাবন্ধ থাকায় এপ্রিলের মজুরি মেটানোর ক্ষমতা ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্টানগুলোর নেই।
এই কঠিন সময়ে শিল্প, বিশেষত ছোট-মাঝারি শিল্পগুলিকে টিকেয়ে রাখতে ত্রাণ প্রকল্পের ঘোষণা করা খুব জরুরী। নইলে টিকে থাকাই কঠিন হবে তাদের।
এক জন কর্মীকেও যাতে কোনও ছাঁটাই না-করে, বারবার সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার।