রাগের মূল রূপ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। ফিউশন যখন করেছেন, রাগকে বিকৃত করেননি। মনে ছিলেন আদ্যন্ত বাঙালি। একান্ত সাক্ষাৎকারে মণিলাল নাগবৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
বৈজয়ন্ত: আপনার বাবা পণ্ডিত গোকুল নাগ উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন৷ তাঁর মানে পণ্ডিত রবিশঙ্করের পরিবারের সঙ্গে আপনাদের পরিবারের যোগসূত্র দীর্ঘ দিনের৷
মণিলাল: উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যোগ দেওয়ার আগে ১৯৩৪ সালে আমার বাবা উদয়শঙ্করের নৃত্যগোষ্ঠীতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন৷ পণ্ডিতজির একদম বাল্যজীবনে তাঁর উপর আমার বাবার বাদনের প্রভাব পড়েছিল৷ সেটা পণ্ডিতজি নিজেই তাঁর বই ‘My Music, My Life’-এ লিখেছেন৷ এই যে - ‘Other events concurred to bring me closer to the sitar in that year. Toward the end of 1934, a wonderful sitar player, Gokul Nag, joined our troupe for a short time and very much impressed me with his artistry. He was another who did much to reinforce my growing interest in the sitar…’৷ উদয়শঙ্কর ১০০ টাকা করে তখন বাবাকে দিয়েছেন পণ্ডিতজিকে শেখাবার জন্য৷ সেই সময়ে পণ্ডিতজি বাবার বাজনা শুনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এবং অনেক জিনিস আমাদের বিষ্ণুপুর ঘরানার বাবার থেকে নিজের মতো করে নিয়েছেন৷
আপনার সাথে পণ্ডিতজির ব্যক্তিগত পরিচয় কখন হয়?
পণ্ডিতজির সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমার ছোট বয়স থেকেই৷ বাবার সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম শেওড়াফুলিতে৷ তখন পণ্ডিতজি জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’-র উপর একটা নৃত্যনাট্য করছিলেন৷ তো সেই সময় আমার বয়স খুবই কম, ১০-১১ বছর বয়স৷ উনি জিজ্ঞাসা করলেন এ কি আপনার ছেলে, বাজাচ্ছে? বাবা বললেন, হ্যাঁ, তো উনি আমার হাত-টাত গুলো দেখলেন৷ দাগ পড়েছে কি না৷ এইভাবে ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হল৷ উনি আমার বাজনা শুনেছেন৷ শুনে খুব প্রশংসা করেছেন৷
আপনি তো বহু নামকরা মানুষের সঙ্গে বাজিয়েছেন৷ পণ্ডিতজির সঙ্গে ঘরোয়া কোনও জায়গায় বাজানো বা প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়েছেন? বা কোনও জলসায়?
না, পণ্ডিতজির সঙ্গে একই ঘরে বাজানো বা প্র্যাকটিস করার সুযোগ আমার হয়নি৷ তবে জলসাতে আমি বাজনা শুনছি, উনি আমায় কাছে ডেকেছেন৷ এখানে বসো, কাছে বসো, এ রকম অনেক জায়গায় হয়েছে৷ উনি নিজেকে সব সময় স্বতন্ত্র করে রাখতেন৷ একটা আলাদা ব্যাপার৷ উনি ছোট বয়স থেকেই প্যারিসে ছিলেন তো, তার উপর দাদা উদয়শঙ্কর তখন একটা বিরাট ব্যাপার৷ সব মিলিয়ে মিশিয়ে উনি প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র, একটা অন্য রকমের ব্যাপার৷
ধরুন, একটা সময়ে গায়করা যত জনপ্রিয় ছিলেন, বাদকরা ততটা ছিলেন না৷ জনপরিসরে উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ বা উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব- এঁদের নাম যতটা জনপ্রিয় ছিল, সেই ভাবে বাদকদের জনপ্রিয়তা ছিল না৷ পণ্ডিতজি এবং অবশ্যই উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব- এঁরা আসার পরে কি ছবিটা পালটাল?
প্রত্যেক শিল্পীর একটা চিন্তাধারা থাকে তো, সেই চিন্তাধারা নিয়ে নিজেই তৈরি করে নেন নিজেকে, গান শুনে শুনে, পাঁচজনের কাছ থেকে শুনে শুনে তৈরি হয় একটা স্বতন্ত্র ধারা৷ সেটাকেই বলে ক্যালিবার, সেটাকেই বলে প্রতিভা৷ এটা নিজস্ব৷ তৈরি হয়ে যায়৷ তো পণ্ডিতজির একটা নিজস্বতা ছিল৷ কারও সঙ্গে মিলত না৷
অনেকে বলেন রাগের যে musical phrasing, তাতে তিনি নাকি ঐশ্বরিক?
তিনি রাগের মূল রূপ সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন৷ সবসময় রাগের রূপের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক করে করতেন৷
এটা গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ একটা সাধারণ ধারণা হল রবিশঙ্কর শুধু fusion করতেন৷
সেটা একটা যখন নাম হয়ে যায়, যখন কেউ সারা বিশ্বব্যাপী কাজ করেন, তাঁকে অনেক কিছুই করতে হয়৷ কিন্ত্ত সে সব কিছু করার মধ্যেও তো নিজস্বতা আছে৷
আপনাদের তো দুটো আলাদা ঘরানা, বিষ্ণুপুরী ঘরানা আর সেনিয়া-মাইহার ঘরানা৷
সেনিয়া মাইহার ঘরানা-র ব্যাপারটা হচ্ছে কি, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ শিখেছেন তানসেনের ঘর থেকেই৷ উজির খাঁ-র কাছে শিখেছেন, যিনি রামপুরের নবাবের দরবারে ছিলেন৷ সেখান থেকে সেনিয়ার সূত্র পাচ্ছেন৷ কিন্ত্ত ঘর একটাই- গোয়ালিয়র৷ সেটাকে বলা হয় তানসেনের সৃষ্টি৷ তান সেনের সৃষ্টি অর্থাৎ, গাছের যে মূল, যে শিকড়, সেটা ঠিকই আছে, শাখাপ্রশাখা অনেক - জয়পুর, বিষ্ণুপুর, দিল্লি, আগ্রা, গোয়ালিয়র - এই সব শাখা-প্রশাখা চলে গেছে৷ কিন্ত্ত সবই সেনি ঘরানার মধ্যে৷ একটা পরিচয় দিতে হয়৷ তাই বলতে হয় বিষ্ণুপুর৷ কিন্ত্ত এই বিষ্ণুপুর ঘরানাও ওই সেনি ঘরানা থেকেই এসেছে৷ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিষ্ণুপুর থেকে সেতার ও সুরবাহারের এই দুটি যন্ত্রের অনেকটা পেয়েছেন৷ আর সেনি ঘরানা থেকে শিখেছেন সরোদ, রবাব এই সব৷ বিশেষ করে আমার বাবা-র সঙ্গে তো পণ্ডিতজির বাজনার খুব সাদৃশ্য পাওয়া যায়৷ পুরনো রেকর্ড শুনলে বোঝা যায় যে বাবার সঙ্গে ওঁর অনেক মিল আছে৷ বরঞ্চ আমার সঙ্গে মিল কম৷ আমি আবার বিলায়েত খাঁ, নিখিল ব্যানার্জি- সবার ভালো ব্যাপারগুলো নিজের মতো করে তুলে নিয়েছি৷পণ্ডিতজির আর একটা ব্যাপার দেখেছি৷ লেকচার-ডেমনস্ট্রেশন দিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন-এ, একটাও ইংরিজি শব্দ বলছেন না, পুরোটাই বাংলায়৷
এতদিন আমেরিকায় থাকার পরও কী করে বাংলায় এত নিঁখুত কথা বলতেন?
এটাই আশ্চর্য, উনি খুব সুন্দর করে বাংলা বলতেন৷ অনেকগুলো ভাষাই বলতে পারতেন৷ প্যারিসে ছিলেন, ফরাসি বলতে পারতেন ভালো৷ খুব রসিক মানুষ ছিলেন৷ বাজাবে তো অনেকেই, নাম করবে অনেকেই, কিন্ত্ত আর কেউ এই ভাবে ইতিহাস তৈরি করে যাবেন না৷ বলা যায় ইতিহাসের একটা অধ্যায় চিরতরে সমাধিস্থ হয়ে গেল৷ যেমন তানসেন৷ তানসেন তানসেনই৷ রবিশঙ্কর তেমনই রবিশঙ্করই৷