এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ
পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত খ্যাত কক্সবাজার এর রামু। সমুদ্রতীরবর্তী শহর হিসেবে কক্সবাজার রামু উপজেলার সংস্কৃতি মিশ্র প্রকৃতির। পূর্ব হতেই মায়ানমারের সাথে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক থাকায় এবং রাখাইন নামক নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করায় কক্সবাজারে বাঙালী এবং বার্মিজ সংস্কৃতির এক অভূতপুর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে রাখাইন সংগীত এবং নৃত্যকলা এ অঞ্চলতো বটেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকাল হতেই দুর্যোগি এবং উত্তল সাগরের সাথে সংগ্রাম করে টিকে রয়েছে বিধায় স্থানীয সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম ও উপস্থাপনায় সংগ্রামের সেই চিত্র ফুটে ওঠে, বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ের প্রাত্যহিক জীবন।
আরাকানের রাম রাজবংশের নামে এই এলাকার নামকরণ হয় বলে জনশ্রুতি আছে। মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়কালে (১৬৬৬) রামুতে বুদ্ধের ১৩ ফুট উঁচু একটি ব্রোঞ্জমূর্তি পাওয়া যায়। এটিই বাংলাদেশে উদ্ধারকৃত সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি। কথিত আছে, রামকোটে অপহৃতা সীতার সঙ্গে রামচন্দ্রের মিলন ঘটে এবং সেখানে একসময় সীতার ব্যবহৃত শিলপাটা রক্ষিত ছিল ।
প্রাচীন কৃষ্টি-সংস্কৃতি পূরাকীর্তি নৃ-তাত্তিক নিদর্শন সমৃদ্ধ হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন, চিরায়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চারণক্ষেত্র রম্যভূমি রামু।
সামাজিক সংহতি সুভ্রাতৃত্ত্ববোধ নির্বিরোধ শান্তিপূর্ণ সহাবস্বানের সমাহিত সৌন্দর্যের সৌম্য মূর্তি, এই চিন্ময় জনপদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। কাব্য করে বলা যায়-
হিন্দু-মুসলীম, বড়ুয়া, রাখাইন, নির্বিবাদী লোক
কৃষ্টি- সংস্কৃতি, জাতি-সম্প্রীতি, ওদের পুণ্যশ্লোক।
উল্লেখ্য, সন্নিহিত বৃহত্তর চট্টলা সমনিতে যুগে যুগে রামু ঐতিহাসিক সিদ্ধ পুরুষ, রাজা- রাজড়া, ওলি -সূফি, শ্রামণ-ব্রাক্ষণ, জাতি-গোষ্টি, পরিব্রাজক ও নৃপতির আগমণ ধন্যা। ফলশ্রতিতে এতদাঞ্চলের জনগণ ঐতিহ্যগত উদার সংস্কৃতির বন্ধনাবদ্ধ। এর মধ্যেও আবার বৃহত্তর চট্টলার অংশ হিসেবে দেশের পর্যটন রাজধানী, প্রাচ্য সৌন্দর্যের রাণী খ্যাত, স্বাস্থ্য-পান্থ-নিবাস কক্সবাজার এর অদূরবর্তী, উদ্ভিন্ন যৌবনা, হিরন্ময়ী রামু যেন কোন উঠতি সুন্দরীর শুন্দ্র কপালে উজ্বল রক্তটিপ।
এই রামুর প্রকৃতি আর আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা একজন অদম্য আর সাহসী মেয়ের নাম মুনা চৌধুরী।তার উদ্যোগের নাম ‘’মুনার হ্যাঁশেল’’। মুনার হ্যাঁশেল ফেসবুক পেইজ থেকে তিনি দেশ থেকে দেশান্তরে।
বিয়ে হয় রামুর সনামধান্য চৌধুরী পরিবারে, স্বামীর নাম মাহবুব আলম চৌধুরীর। তিন ছেলে মেয়ের নিয়ে তার আত্মা, তার প্রাণ। ছোট বেলা থেকে গ্রামে প্রকৃতির সাথে তার বেড়ে উঠা, ইচ্ছা ছিলো পড়ালেখা শেষ করে নিজের ক্যারিয়ার গড়া,নিজের পায়ে দাড়ানোর আর এই অদম্য ইচ্ছা শক্তি তাকে এল.এল.বি পর্যন্ত নিয়ে গেল, সালটা ছিল ২০০০। কিন্তু সব মানুষের তো আর তার ইচ্ছা চাইলেই পূরণ হয় না, কিছু না কিছু স্বপ্ন অধরা থেকেই যায়, তার ক্ষেত্রেও হয়তো ভাগ্য সাথ দেয় নাই,এল.এল.বি কম্প্লিট না করার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আইন নিয়ে কাজ করবে , সুবিধাবঞ্চীত নারিদের হয়ে লড়াইটা আর করা হলোনা তার।
মুনা চৌধুরী বলেন, তবে হ্যাঁ, এই কথা সত্য ভাগ্য হয়তো পুরোপুরি আমাকে অস্বীকার করেনি, কিছুটা হলেও আমার সাথে ছিল,,আর তাইতো বিয়ের পর, আমার স্বামী আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে, না না!! সাংসারিক কাজ করার জন্য না!! আমার ওই যে পিছিয়ে পড়া স্বপ্ন, নিজের পায়ে দাড়ানোর স্বপ্ন, তা পুরনে, ব্যাস,আমার স্বামীর সাপোর্ট সাথে নিয়েই আমি এক স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে গেলাম ২০০৭ এ।
ভালোই লাগতো শিক্ষাকতা, কিন্তু পরে আমার তৃতীয় বেবি হওয়ার পর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ বাবুর খেয়ালও্তো রাখতে হবে। আমার স্বামী যথারীতি সাপোর্ট করেই গেল আর আমার ইচ্ছাও থেমে থাকেনি। এরপর অনেক বছর কেটে গেল, চিন্তা করলাম আবার চাকরী শুরু করব, কিন্তু এক অদৃশ্য আত্মা আমাকে বাধা দিচ্ছিল, তাই কি করব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ভাবলাম আমার বানানো খাবার তো সবাই খুব পছন্দ করে, কেননা এই পছন্দ করা আর খাবার দুইটাই একটা পর্যায়ে নিয়ে গেলে তো আর মন্দ হয় না।
সেই ভাবনা থেকেই রান্নাকে আরো পারফেক্ট করতে ট্রেনিং শুরু করি। নিজের তিলতিল কবে গচ্ছিত সঞ্চয় দিয়ে আমি ক্যাটারিংয়ের যাবতীয় সারংজাম কিনি ও ট্রেনিং শুরু করি, যা ছিল আমার জন্য আসলেই চ্যালেঞ্জ। আমার মনোবলই ছিলো আমার বড় সম্বল আলহামদুলিল্লাহ।
খুব সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু তার পর আজকের এই আমি। পরিবার কিম্বা সমাজ কোনো দিক থেকে আমি কখনো বাঁধার সম্মুখীন হয়নি বরং বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা পেয়েছি।
এই সহযোগিতা সামনে নিয়ে ২০১৯ সাল, আরো কিছু ট্রেনিং নিতে ঢাকা চলে যায়। আরো অনেক গুলো রান্নার কোর্স আমি কমপ্লিট করি সাথে সাথে আমার কেটারিং বিজনেস চালিয়ে যায়। প্রায় ৪বছর আমি এই বিজনেস চালিয়ে যাচ্ছি, এই ব্যাবসা থেকে আমার আয়ও রোজগার মাশাল্লাহ খুবই ভালো।
আগামীর স্বপ্ন, যা আমি লালন করিঃ
মাণ সম্মত খাবার মানুষের কাছে ও কক্সবাজারের পর্যটকের হাতে তুলে দিতে ব্যপক ভাবে ভাবে কাজ করার ইচ্ছা রাখি,
১। মান সম্মত খাবারের দোকান চালু করা।
২। গ্রাম বাংলার পিঠা পুলি ও ভালো মানের আচারের দোকান দেওয়া।
৩। খাবারের উপর ট্রেনিং সেন্টার চালু করা।
৪। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে থাকবে মোনার হ্যাসেল -এর আচার।
মুনা চৌধুরী বলেন, সামাজিক ব্যবস্থায় নারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে নারীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন না। ইচ্ছে আছে নারীদের কল্যাণে, সহায়তায় ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করার। নিজের পুঁজি খাটিয়ে আজ অনেক নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পেরেছি। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে হয়তো নারীদের উন্নয়নে আরেকটু এগোতে পারব। সমাজের পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, নির্যাতিত নারীদের নিয়ে সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই। তাদের স্বাবলম্বী করতে চাই। আর এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই পথচলা অব্যাহত থাকবে।