দিনের শুরুতে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার খান। এসময়ে কর্টিজ়লের মাত্রা বেশি থাকে। তাই, ব্রেকফাস্টে ডিম, দুধ রাখতে পারেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে প্রবল আলস্য। ব্রেকফাস্ট, টিফিন গোছানো, অফিসের ফাইল রেডি করার মতো এক-একটা কাজও তখন যুদ্ধজয়ের সমান! কারণ, ঘুমের রেশটুকু কাটলেও এনার্জির ভাণ্ডার খালি। নিজেকে রীতমিতো ‘মোটিভেট’ করে অফিসে রওনা দিলেও সারাদিন ক্লান্তি আর এনার্জির অভাব আপনার নিত্যসঙ্গী। কোনও কাজে উৎসাহ পান না, অল্পেতেই মেজাজ খিটখিটে, রাতে ভাল ঘুমও হয় না। এদিকে দিনে-রাতে আপনাকে যেন রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে ‘এনার্জি’-র সঙ্গে। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতে পারাটাই আপনার কাছে স্বর্গীয় সুখ। তখন যদি বাচ্চা বায়না করে বা বাড়ির লোকের সঙ্গে গল্প করতে হয়, তা কী আর ভাল লাগে! আসলে, স্ট্রেস-ঘুমের অভাব-জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এগুলো সবই এনার্জি কমার জন্য দায়ী। তবে এনার্জি বাড়ানোর উপায়ও নিশ্চয়ই আছে। সেই উপায় মেনে চললেই সারাদিন শরীর-মন সতেজ থাকবে!
কতটা এনার্জি দরকার
এনার্জির প্রয়োজনীয়তা মূলত নির্ভর করে শারীরিক ওজনের উপর। স্বাভাবিক ওজনের একজন ব্যক্তি যদি অ্যাক্টিভ জীবনযাপন করেন, তাহলে তার ক্ষেত্রে এনার্জির প্রয়োজনীয়তা বাকিদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। স্বাভাবিক ওজনের কোনও ব্যক্তি যদি মাঝারি মানের পরিশ্রম করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি শারীরিক ওজনের হিসেবে ৩০ কিলোক্যালরি এনার্জির প্রয়োজন। অর্থাৎ, কারওর যদি ৫০ কেজি ওজন হয়, তাহলে দিন প্রতি তাঁর এনার্জির প্রয়োজনীয়তা হবে ১৫০০ কিলোক্যালরি। ২৩-৩০-এর মধ্যে বিএমআই বলে তাঁকে ‘ওভারওয়েট’ বলে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে তাঁদের ওজনের ২০ গুণ এনার্জি তাঁদের দৈনিক প্রয়োজনীয়তা। আবার বিএমআই ৩০-এর উপরে হলে তাঁকে ‘ওবিস’ বলা হয়। এঁদের ক্ষেত্রে সাধারণত দৈনিক ১২০০ কিলোক্যালরি এনার্জি প্রয়োজন। কিন্তু কেউ যদি ‘মর্বিড ওবিসিটি’-তে ভোগেন, অর্থাৎ বিএমআই ৪০-এর উপর হয়, তাহলে তাঁর ক্যালরির প্রয়োজনীয়তা আরও কম। বুঝতেই পারছেন যে ওজনের সঙ্গে ক্যালরির প্রয়োজনীয়তার একটা যোগ আছে। তবে শুধুই শারীরিক ওজন নয়, ঠিক কতটা এনার্জি আপনার প্রয়োজন তা নির্ভর করবে আরও একাধিক বিষয়ের উপরে! ডায়াবিটিসে গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার খেলে ব্লাড সুগারের মাত্রা খুব দ্রুত বেড়ে যায়। যাঁদের ডায়াবিটিস আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে যেমন দৈনিক ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে, তেমনই গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবারও পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। ফলে, আপনার এনার্জির প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটা, তা নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে: শারীরিক ওজন, ডায়াবিটিস ও পরিশ্রমের পরিমাপ। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির যদি ৬০ কেজি ওজন হয় ও তিনি খুবই অ্যাক্টিভ জীবনযাপন করেন, তাহলে দৈনিক ১৮০০-২০০০ কিলোক্যালরি এনার্জির প্রয়োজন হয়।
এনার্জির অভাব
একজন ব্যক্তির যে পরিমাণ এনার্জি প্রয়োজন, তার চেয়ে কিছুটা কম হলেই তিনি এনার্জির অভাবে ভুগতে পারেন। অনেকেই আছেন যাঁরা প্রায় সবসময়ই ক্লান্ত থাকেন! কোনও কাজেই উৎসাহ নেই। সাধারণত, আমরা ধরেই নিই যে এঁদের এনার্জির বড্ড অভাব! মাথায় রাখতে হবে, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কিলোক্যালরির হিসেবটুকুই ঠিকঠাক রাখলে হবে না! এনার্জি সোর্সও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কার্বোহাইড্রেট থেকে ৫০ শতাংশের বেশি কিলোক্যালরি যেন না আসে! বাকি ৩০ শতাংশ প্রোটিন আর ২০ শতাংশ ফ্যাট থেকে আসবে। ফ্যাটের মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রায় সকলেরই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা দরকার। ঘি, মাখন, রেড মিট ইত্যাদিতে এধরনের ফ্যাট থাকে। এনার্জির যে ২০ শতাংশ ফ্যাট থেকে আসবে, তা যেন মোনো-আনস্যাচুরেটেড ও পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হয়। যদি শুধুই কার্বোহাইড্রেট খেয়ে পেট ভরান, তাহলে শরীর কিন্তু পর্যাপ্ত এনার্জি পাবে না। ব্যালেন্সড ডায়েটই এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা!
ইনস্ট্যান্ট এনার্জি
সারা দিন পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে পড়লে হঠাৎ করে এনার্জি বাড়াতে এনার্জি ড্রিংক খান অনেকেই। আসলে, এনাজি ড্রিংকের মধ্যে ব্রেন স্টিমুলেন্ট উপাদান থাকে। চা-কফি খেলে যেমন একটু চাঙ্গা লাগে, এগুলোও ঠিক সেভাবেই সাময়িকভাবে আপনাকে এনার্জি দেবে। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। হার্টরেট বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ বাড়া ইত্যাদি হতে পারে। বিশেষত যাঁদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এধরনের তাৎক্ষণিক এনার্জি-বুস্টার না খাওয়াই ভাল। এনার্জি ড্রিংক সকলের দরকারও হয় না। একজন সাধারণ মানুষ যিনি মাঝারি মানের পরিশ্রম করেন, তাঁর এনার্জি ড্রিংক বা এই জাতীয় কোনও পানীয়ের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যিনি একজন অ্যাথলিট বা অত্যন্ত বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন, তাঁর ক্ষেত্রে এনার্জি ড্রিংক না হলেও, ইলেকট্রোলাইট জাতীয় কোনও পানীয়ের প্রয়োজন আছে। প্যাকেজড ড্রিংক যতটা পারা যায় এড়িয়ে চলে ন্যাচারাল জুস বা নুন-চিনির শরবতও খেতে পারেন।
ডায়েটে কী কী রাখবেন
প্রথমেই খেয়াল রাখুন, অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেন ডায়েটে না থাকে। এতে হয়তো সাময়িক এনার্জি আসবে ঠিকই, কিন্তু এর দীর্ঘকালীন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। প্রোটিনের উৎস হিসেবে আপনি যদি রেড মিট খান, তাহলে কিছুটা এনার্জি পাবেন ঠিকই, কিন্তু এতে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে। ফলে, এনার্জি-সোর্স বেছে নিতে হবে এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে রেড মিট খেলে অসুবিধে নেই।
ক্লান্তি কাটানোর দাওয়াই
গরমে শারীরিক ক্লান্তি একটু আসবেই। আমাদের দেশে গরমকালে যেমন তাপমাত্রা বাড়ে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বাড়ে আর্দ্রতা। অতিরিক্ত পরিমাণে ঘাম হওয়ার ফলে শরীর তাপমাত্রা বের করতে পারে না। তাই চেষ্টা করুন খুব বেশিক্ষণ গরমে না থাকতে। বয়স্ক মানুষ ও যাঁরা রক্তচাপের ওষুধ খান, তাঁদের ক্ষেত্রে হিট-কন্ট্রোলের বিষয়টা আরওই কঠিন। গরমে বেশিক্ষণ থাকতে হলে প্রচুর পরিমাণে জল খান। নার্ভের ওষুধ বা প্রেশারের ওষুধ যাঁরা খান, তাঁরা বেশিক্ষণ চড়া রোদে থাকলে ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। হিট এগজ়শন বা হিট ইনজুরির আশঙ্কাও বাড়ে এঁদের ক্ষেত্রে। আবার যাঁরা গরমে পরিশ্রম করতে একেবারেই অনভ্যস্ত, তাঁরাও একটুতেই প্রবল ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। মোটা ব্যক্তিরাও দ্রুত শরীর থেকে তাপমাত্রা বের করতে পারেন না। এঁদের প্রত্যেকেকেই প্রচুর জল খেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কোনওভাবেই ডিহাইড্রেশন না হয়। এমনিতে যাঁরা প্রায় সবসময়ই ক্লান্তবোধ করেন তাঁরা নিয়মিত এক্সারসাইজ় করুন। ক্লান্তির অন্যতম কারণ কিন্তু স্ট্রেসও হতে পারে। এক্সারসাইজ় স্ট্রেস লেভেলও কমায়।
বিশ্রামের ভূমিকা
এনার্জি ধরে রাখতে গেলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঘুম। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সাত ঘণ্টা ঘুমনো প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই এতক্ষণ ঘুমনোর সময় নেই! আজকাল তো আবার অনেকেই ঘুমের আগে মোবাইল আর ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন। কেউ কেউ ঘুমের আগে টি.ভি দেখে ঘুমোতে যান। এগুলো সাউন্ড স্লিপ না হওয়ার না ঘুম না আসার অন্যতম কারণ। ঘুমের অন্তত একঘণ্টা আগে ব্লু-লাইট এক্সপোজ়ার বন্ধ করতে হবে। আসলে আমাদের মস্তিষ্কের কিছুটা সময় লাগে ‘শাট অফ’ করতে। যতক্ষণ না সেটা সম্ভব, ততক্ষণ ভাল ঘুম সম্ভব নয়। তাই, ভাল ঘুমের জন্য বিছানায় শুয়ে শুয়ে টি.ভি দেখা বা মোবাইল ঘাঁটার অভ্যেস বন্ধ করতে হবে। আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেন না। এক্ষেত্রে দিনের বেলায় ঘুমের অভ্যেস থাকলে তা বন্ধ করুন। আর অবশ্যই এক্সারসাইজ় করতে হবে। এক্সারসাইজ়-ঘুম-এনার্জি, এই তিনটেই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণভাবে, এক্সারসাইজ় করেও ঘুম না এলে সেই ব্যক্তির স্ট্রেস বা অ্যাংজ়াইটি আছে কি না দেখতে হবে। ভাল ঘুমের জন্য স্লিপ হাইজিন মেনে চলা জরুরি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমনোর চেষ্টা করুন। সাধারণত প্রতিদিন যে জায়গায় ঘুমোন, সেখানেই ঘুমোলে ভাল ঘুম হয়। ঘুমের আগে বই পড়তে পারেন, বা গান শুনতে পারেন।
এনার্জি বাড়ানোর টোটকা (বক্স)
দিনের শুরুতে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার খান। এসময়ে কর্টিজ়লের মাত্রা বেশি থাকে। তাই, ব্রেকফাস্টে ডিম, দুধ রাখতে পারেন। দিনের শুরুতেই কার্বোহাইড্রেটে ভরপুর খাবার কেলে এনার্জি হারাবেন দ্রুত।
সারাদিনের খাবার ছোটছোট ভাগে বিভক্ত করে খান। এতে একেবারে বেশি খাওয়া হবে না। মিড-ডে স্ন্যাকিংয়ের জন্য ফল, বাদাম খেতে পারেন।
প্রচুর জল খান। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখুন। জলের অভাবে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে, এনার্জির অভাব ও মুড সুইং হতে পারে।
ভাল ঘুমের জন্য বেডরুম হাইজিন মেনে চলুন। শোওয়ার ঘরে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ হাওয়া-বাতাস চলাচল করে। শোওয়ার ঘরকে যতটা পারেন গ্যাজেট ফ্রি রাখুন। ঘুম না আসতে চাইলে উঠে হেঁটে আসুন। ঘুমের আগে স্নান করলেও অনেকে ভাল ঘুমোন।
এক্সারসাইজ়ে অনীহা থাকলে হাঁটা বা দৌড়নোর মতো কার্ডিও এক্সারসাইজ় করতে পারেন। সাঁতারও কাটতে পারেন। মেটাবলিজ়ম রেট বাড়বে, ওজন কমবে আর ঘুমও হবে ভাল। ফলে, সারাদিন কাজ করার এনার্জি পাবেন।
স্ট্রেস আর ক্লান্তি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। স্ট্রেস পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না হলেও চেষ্টা করুন স্ট্রেসের মাত্রা যতটা সম্ভব কমানোর। মেডিটেশন, যোগাসন কাজে দিতে পারে।
অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ রেস্ট (বক্স)
টানা কাজ করতে করতে ‘বার্নআউট’ হয়ে যান অনেকেই। আজকের ব্যস্ত যুগে এই বিষয়টি একেবারেই নতুন কিছু নয়! বার্নআউট ঠেকাতে রিল্যাক্স করতে শিখুন। হ্যাঁ, রিল্যাক্স করাটাও কিন্তু রীতিমতো শেখার বিষয়। অফিস-ডেডলাইন-সংসারের চাপে আমরা রিল্যাক্স করতেই ভুলে গিয়েছি! ফলে, মস্তিষ্কও নন-চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে অভ্যস্ত থাকে না। সবসময় অতিরিক্ত কাজের চাপে সৃজনশীল চিন্তাভাবনারও সুযোগ পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম কিন্তু ক্রিয়েটিভিটি ও প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে সাহায্য করে। সারাদিন পরিশ্রমের পর অ্যাক্টিভ রেস্টের প্রয়োজন। সাঁতার, সাইক্লিংয়ের মতো রেস্টোরেটিভ অ্যাক্টিভিটি এসময়ে প্রয়োজন। আর প্যাসিভ রেস্টের ক্ষেত্রে আপনি বিশ্রাম নিলেও আপনার মন কিন্তু সজাগ থাকছে। বিছানায় শুয়ে থাকলেন বা জানলার দিকে মুখ করে বসে থাকলেন…এই পরিস্থিতিগুলো আপনার মস্তিষ্ককে রোজকার স্ট্রেস থেকে সাময়িক ‘ব্রেক’ দেবে।