সমাজগুলি যখন তাদের অর্থনীতিগুলিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়, এটি কেবল তাদের সংকট থেকে বাঁচতে সহায়তা করে না - এটি তাদের চীরতরে পরিবর্তিত করে।
পর্ব-১
পৃথিবী কি করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ? গত মাসে, শি জিনপিং চীনা দমন প্রচেষ্টাটিকে “জনগণের যুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছে; গত সপ্তাহে, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে একজন “যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতি” হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, এবং এমমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছিলেন যে ফ্রান্স COVID-19 এর সাথে “যুদ্ধে” রয়েছে।
মহামারীর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া বাষ্পকে একত্রিত করার সাথে সাথে যুদ্ধকালীন সংঘবদ্ধতার বাণীটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। সারা বিশ্ব মহামারীর বিরুদ্ধে প্রস্তত হচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালিতে সরকারের এন্টি-ভাইরাস টাক্সফোর্স প্রধান এই রোগের মোকাবেলায় দেশটিকে “যুদ্ধের অর্থনীতিতে সজ্জিত করার” আহ্বান জানিয়েছে।
২০০৮ বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়, নীতিনির্ধারকরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বোঝানোর প্রচেষ্টা বর্ণনা করার জন্য যুদ্ধের মতো ভাষা ব্যবহার করার, (“big bazookas” এবং “shock and awe”) অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার মোট প্রকৃতি যুদ্ধকালীন অর্থনীতির রূপককে আজ আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি আর্থিক বাজারগুলি শান্ত করার জন্য যেমন কাজ করছে তেমনি সরকারগুলিও জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা পরিচালনা করছে, হাসপাতাল তৈরির জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করছে এবং নাগরিকদের চলাচলকে সামাজিক দূরত্বের দ্বারা সীমাবদ্ধ করছে।
কিন্তু করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর উপায় হিসেবে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি আসলে কেমন হতে পারে? ধারণাটি বিভিন্ন বিষয়কে বোঝানো হয়েছে: উত্পাদনশীলতা, ত্যাগ, সংস্কার, সংহতি এবং সম্পদ। এর মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্র, বিশ্বব্যাপী মহামারী সম্পর্কে যুদ্ধ চিন্তা করার উপযুক্ত উপায় নয়। অন্য দিক থেকে, পশ্চিমা সরকারগুলির যুদ্ধকালীন বাজে বক্তব্য ব্যবহারের বাইরে চলে যাওয়ার সময় এসেছে। বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধকালীন অর্থনীতির ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ইতিমধ্যে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে।
মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যুদ্ধকালীন জরুরী অবস্থায় উত্পাদন বাড়ানো এবং সেবা প্রসারণ করার জরুরি প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
COVID-19 এ খুব বেশি প্রয়োজন ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট,বিশ্বজুড়ে নিবিড় যত্ন ইউনিটকে ছাপিয়ে গেছে, আমাদের আরও পরীক্ষার কিট, হাসপাতালের শয্যা, ভেন্টিলেটর মেশিন, মুখোশ এবং সুরক্ষামূলক পোশাক প্রয়োজন — এগুলির মধ্যে অনেকগুলি অতি দ্রুত সরবরাহ করা দরকার।
বর্ধিত জরুরী সেবা ক্ষমতা সরবরাহের বাধাগুলির মুখোমুখি হচ্ছে দেশগুলো, উদাহরণস্বরূপ, পরীক্ষায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল রিএজেন্ট এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিত্সা কর্মীদের কমতি।
মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা উত্পাদন আইনে (ডিপিএ) গত সপ্তাহে আহ্বান করেন, একটি স্নায়ুযুদ্ধ আইন, যাতে কৌশলগত খাতগুলিতে বেসরকারী শিল্পগুলিকে সম্প্রসারণে সহায়তা করার জন্য সংস্থানকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বরাদ্দ দেওয়ার অনুমতি দেয়, এটি একটি বৃহত্তর মেডিকেল গণ-উত্পাদন বেস তৈরির এক পদক্ষেপ ।
ডিপিএর তুলনায় বেসরকারী খাতের উপর নির্ভরযোগ্য মডেল রয়েছে; একটি গুরুত্বপূর্ণ শান্তির পূর্বসূরী হ’ল নিউ ডিল-এরা ওয়ার্কস প্রগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এই ধরণের পাবলিক স্কিমটি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যারা কাজ করে আসছে সপ্তাহ এবং মাসগুলিতে বেকারত্বের মুখোমুখি হতে পারে তাদের কাজে লাগানো।
ইতিবাচক অর্থনৈতিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকার পাশাপাশি, এই জাতীয় কর্মসংস্থান রাষ্ট্রের সক্ষমতা প্রসারিত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার উতপাদনে নিউ ইয়র্কের জেল শ্রমের ব্যবহার করেছে তারা।
যুদ্ধ-অর্থনৈতিক উত্পাদন প্রায়শই একটি জাতীয় উদ্যোগ হিসাবে দেখা যায়।তবে বিংশ শতকের বেশিরভাগ যুদ্ধ অর্থনীতি আন্তর্জাতিক সাপ্লাই লাইন সৃষ্টির প্রয়োজন। COVID-19 এর বিরুদ্ধে মেডিকেল মোবিলাইজেশন একইভাবে বিশ্বব্যাপী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭৩,০০০ ভেন্টিলেটর রয়েছে। স্বল্পমেয়াদে, আমেরিকান প্রয়োজন বৃদ্ধি পাবে ব্যাপক ভাবে। বিশ্বব্যাপী বার্ষিক উত্পাদিত মেশিনের পরিমান ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০। শুধু আমেরিকাতেই বিশ্বের মোট উত্পাদিত মেশিনের চাহিদা ছাড়িয়ে যাবে।
ভেন্টিলেটর জটিল প্রকৃতির হওয়াতে এবং উচ্চ স্যানিটারি প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে, এডিপিএ কেবলমাত্র মেডিকেল মেশিন উত্পাদনের জন্য ছোট আকারের ম্যানুফেক্সারিং প্লান্ট অনুমতি দেবে। তাদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু তারা যাতে করে মিটাতে পারে। একা কোন দেশ আসলে এই ধরনের প্রডাক্ট উতপাদন করে পোষাতে পারবে না।
যেখানে ভাইরাসটির প্রাদূর্ভাব কম আছে তারা এইসব পন্যগুলি উতপাদন করে যারা করোনার কারনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে সাপ্লাই দিবে।
১৯৪০-এর দশকে যেমন লেন্ড-লিজ এবং বার্লিন বিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উত্পাদিত যুদ্ধের উপাদান সরবরাহ করেছিল।
পূর্ব এশিয়া, যেখানে ভাইরাসটি আপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রণাধীন, সেখানে ভেন্টিলেটরগুলি ব্যাপকভাবে উত্পাদন করা যায়।
২০২০-এর বৈশ্বিক উত্পাদন ঘাঁটিতির বাস্তবতা থেকেই বোঝা যায় যে চীনের উতপাদিত ভেন্টিলেটর বিমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে এবং মেশিন যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হবে পশ্চিমা এমার্জেন্সি কেয়ারে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের তাত্ক্ষণিক চিকিত্সা ছাড়াই পশ্চিমা সরকারগুলি উত্পাদন বাড়ানোর পরিবর্তে প্রায় সর্বজনীনভাবে তা বন্ধ করে দিয়েছে।
একজন আর্থিক বিশ্লেষক যেমন উল্লেখ করেছেন, “লকডাউন অর্থনীতি” বিভিন্নভাবে যুদ্ধের সময়কালের পুরো অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। উভয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, অর্থনৈতিক সংহতকরণ অভূতপূর্ব ছিল, পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকদের উত্পাদনের জন্য বড় বড় দলকে তালিকাভুক্ত করেছিল এবং তাদের উতপাদনে লাগিয়েছিল। কিন্তু করোনভাইরাস সরবরাহের চেইনগুলির ব্যাহত করছে এবং আজকের সামাজিক দূরত্বের ব্যবস্থা মিলিয়ন মিলিয়ন কর্মচারীকে উত্পাদন এবং পরিষেবা খাতে কাজের বাইরে রাখছে।
পর্ব -২
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। করোনাভাইরাসের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া, যার প্রভাব দেখা যাবে ভবিষ্যতেও। করোনা মহামারীর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ব যেভাবে বদলে যেতে পারে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন:
জাতীয় নিরাপত্তা এবং গুপ্তচরবৃত্তি
অনেক দিন থেকেই মানুষের একটা আশঙ্কা ছিল যে, সন্ত্রাসীরা বা কোনো গোষ্ঠী হয়তো যে কোনো সময় জীবাণু অস্ত্র ছেড়ে দিতে পারে। এখন এ আশঙ্কা অনেকে বাস্তব মনে করছেন। তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক গোষ্ঠী হয়তো জীবাণু অস্ত্রের কথা নতুন করে ভাবতে বসবে। ফলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন হবে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি কাজ করতে হবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও। বার্তা সংস্থা বিবিসি বলছে, বর্তমান করোনা সংকটের পর এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হবে। কারণ ইতিমধ্যেই কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, কোনো কোনো চরম দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস ছড়ানোর কথা ভেবেছে। তবে আমেরিকার বিচার বিভাগ বলেছে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করলে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ আনা যাবে। বর্তমান সংকটের পর একটা প্রশ্ন সামনে আসতে পারে যে যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ নজরদারি ব্যবস্থা উন্নত তারা এ ধরনের ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে কতটা আগ্রহী বা উদ্যোগী হবে!
বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা গর্ডন করেরা বলছেন, গোয়েন্দারা যত গোপন তথ্যই সরবরাহ করুক না কেন, ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছে তারা এসব তথ্য কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে এবং তা কাজে লাগাচ্ছে তার ওপরই নির্ভর করে এসব তথ্য শেষ পর্যন্ত মানুষের কতটা উপকারে আসবে। যে তথ্য মানুষের চলাচল সীমিত করে এর আরও ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে কাজে লাগবে। সোজা কথায়, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে গোয়েন্দা নজরদারির জন্য দেশগুলোর ওপর ভবিষ্যতে দেশের ভিতরে যেমন, তেমনি বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিসরে চাপ বাড়বে। তবে ভবিষ্যতে আসল পরিবর্তন আমরা দেখব আরও জটিল তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে। যেমন একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তা বুঝতে বা খুঁজতে ব্যবহার করা হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বজুড়ে যে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে নিশ্চিত করেই বলা যায়, ভবিষ্যতে মানুষের নিরাপত্তায় অনেকখানি মাথাব্যথার কারণ হবে জৈব-অস্ত্র। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে দেশে দেশে আলাদা এক বা একাধিক সংস্থাকে কাজ করতে হবে। আবার এমনটাও হতে পারে যে, এ ধরনের সমস্যা যেহেতু বৈশ্বিক। তাই আন্তর্জাতিকভাবেও এক বা একাধিক সংস্থা প্রতিটি দেশে এবং বিপজ্জনক গোষ্ঠীগুলোর ওপর নজরদারি শুরু করবে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য এ মুহূর্তে বড় প্রশ্ন- এ সংক্রমণের ধাক্কা সরকারের প্রশাসন ও তার সামরিক শক্তিকে কতটা দুর্বল করে দিতে পারে এবং তার থেকে কে কোন দিক দিয়ে কী ধরনের সুযোগ নিতে পারে। কিছু গোয়েন্দা সংস্থা এ ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ইতিমধ্যেই কিছু কাজ করেছে। যেমন জানা গেছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এক অভিযান চালিয়ে এক লাখ টেস্টিং কিট বিদেশ থেকে আনিয়েছে। এখন সময়ই বলে দেবে ভবিষ্যতের জাতীয় নিরাপত্তা এবং গুপ্তচরবৃত্তি কোন পথে এগোচ্ছে।
নিশ্ছিদ্র নজরদারি
ইতিমধ্যেই বদলে গেছে পৃথিবীর চেহারা। পুরো মানব জাতি আজ সংকটের মুখে। করোনা-পরবর্তী সময়ে কেমন হবে বিশ্ব, তা নিয়ে গবেষকরা দিচ্ছেন নানা মত। অনেকে মনে করছেন ভবিষ্যতে নাগরিকদের কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হতে পারে। শুধু আপনি কী করছেন তা-ই নয়। এমনকি আপনার শারীরিক অবস্থার সম্পূর্ণ তথ্য থাকবে সরকারের কাছে। ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে বলেছেন, এখন পর্যন্ত আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে কোনো লিঙ্কে আপনি যখনই আঙ্গুল দিয়ে ক্লিক করেছেন, সরকার শুধু জানতে চেয়েছে, কিসের লিঙ্কে আপনি ক্লিক করেছেন। কিন্তু এই করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের ফোকাসটা সরে গেছে অন্যদিকে। এখন সরকার জানতে চায়, আপনার আঙ্গুলের তাপমাত্রা কত, ত্বকের নিচে আপনার রক্তের চাপ কত।
মহামারী আটকাতে হলে গোটা জনগোষ্ঠীকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। না হলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। ইউভাল নোয়াহ হারারি দুটি উপায়ের কথা বলেছেন। একটা হচ্ছে সরকার তার জনগণকে নজরদারির মধ্যে রাখবে এবং নিয়মকানুন মেনে না চললেই শাস্তির ব্যবস্থা। আগে নাগরিকের ওপর ২৪ ঘণ্টা নজরদারির কথা ভাবতেও পারত না কেউ। এখন সরকারগুলো দেশের সবখানে ছড়িয়ে থাকা সেন্সর আর শক্তিশালী অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজটা করতে পারে খুব সহজেই।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ইতিমধ্যেই নতুন সব সারভেইল্যান্স টুল ব্যবহার করেছে এবং করছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে চীনে। আমজনতার স্মার্টফোন খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, কয়েক শ মিলিয়ন ফেস-রিকগনাইজিং ক্যামেরা ব্যবহার করে, জনগণকে নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা এবং অবস্থা রিপোর্টে বাধ্য করে চাইনিজ সরকার শুধু দ্রুত ভাইরাস বাহক শনাক্তকরণই নয়, সেই বাহকের চলাফেরা ট্র্যাক থেকে শুরু করে কাদের সংস্পর্শে ভাইরাস বাহক ছিল তাও বের করে ফেলেছে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে দেশে এ ব্যবস্থা সব নাগরিকের ওপর প্রয়োগ করা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।
গুরুত্ব বাড়ছে রোবটের
শিল্প-কারখানায় উৎপাদনকাজে ক্রমেই রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। ধীরে ধীরে যন্ত্রের দখলে চলে যাচ্ছে শ্রমবাজার। আর এবার করোনার প্রাদুর্ভাবে আরও প্রকট আকার দেখা দিচ্ছে। কারণ মানবকর্মীর কারণে বন্ধ রাখতে হচ্ছে কলকারখানা। এদিক থেকে রোবটের কাছে হেরে যাচ্ছে মানুষ। তাই মানবশ্রমিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে বসেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শ্রমবাজারের ৫২ ভাগই চলে যাবে রোবটের দখলে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল এ খবর জানিয়েছে আরও আগেই। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে যত মানুষ কর্মরত রয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের অর্ধেকই ছাঁটাইয়ের কবলে পড়বেন। সেই জায়গায় কাজ করবে যন্ত্রচালিত রোবট। আর এ আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত করতে এর পেছনে কাজ করতে পারে করোনার প্রাদুর্ভাবও।
পতনের দিকে আমেরিকা
করোনার সংক্রমণ ও এর বিশ্বায়নের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুরুতে তেমন একটা পাত্তা না দিলেও বর্তমানে আমেরিকায় করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৩ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৪০৬ জনের। তবে আমেরিকার শক্তির অবক্ষয়ের পেছনে বেশ কিছু উপাদান সক্রিয়। এগুলো হচ্ছেÑ চীনের অর্থনীতির বিস্ময়কর উত্থান। আরও রয়েছে পারমাণবিক শক্তির ক্রমবিস্তৃতি, মুক্তবাণিজ্যে অনেক দেশের অনীহা, সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ফলে অনিবার্যভাবে সামরিক খাতে ব্যয় সংকোচন করতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মিত্র যেমন ইউরোপ ও জাপানের শক্তি কমে যাওয়া।
বিশ্ব নেতৃত্বে চীন!
করোনা পরবর্তী বিশ্বে বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র না চীন? চীনের উহানে করোনা সংক্রমণ শুরু হলেও সেখান থেকে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। পুরো চীনেই এখন অর্থনীতির চাকা সচল। তাদের অর্থনীতিবিদরা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, আগামী মাস থেকে তাদের অর্থনীতির গতিপথ নতুন দিকে যাবে। করোনা শনাক্তের কিট থেকে শুরু করে এর সংক্রমণ রোধে কার্যকর উপায়, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহসহ এ দুর্যোগকালীন সবাই চীনের দিকে তাকিয়ে আছে। সা¤প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের দেওয়া দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব বহন করছে। বৈশ্বিক নেতৃত্বের বদলের ধরনটি হচ্ছে, শুরুতে অতি ধীরগতিতে এর বদল শুরু হয়। পরে হঠাৎ করেই দেখা যায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে। এতদিনের চিরচেনা বিশ্ব করোনা পরবর্তী সময়ে যে আগের মতো থাকবে না এটা নিশ্চিত। যার প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব নেতৃত্বে- এ কথা বলাই যায়। বিশ্বের নেতৃত্ব যে গোষ্ঠীর হাতে ছিল এখন আর তা নেই। অনেকেই মনে করছেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে চীন।
অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা
বিগত কয়েক বছর ধরেই ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আর তথ্যের প্রাচুর্যতার কারণে অনলাইন এডুকেশন ব্যাপারটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন যাদের জন্য সময়, অর্থ এবং শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের সব কিছু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে অনলাইন এডুকেশন চালু করেছে। এটি ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকহারে চালু হতে পারে। শিক্ষা এখন সার্বজনীন, এখন কোনো নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোর্স করার জন্য সুদূর পথ পাড়ি দিতে হয় না, বরং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই সেই শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ইউনিভার্সিটি অব ফিওনিক্স-এর মাধ্যমে অনলাইন এডুকেশনের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এটি প্রায় ৩৪ বিলিয়নের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে অনলাইন এডুকেশনের হাত ধরেই লাখ লাখ শিক্ষার্থী তাদের জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘরে বসেই অফিস
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার বেড়ে চলায় এবার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্মীদের ঘরে বসেই কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। যেমন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ইউরোপিয়ান প্রধান কার্যালয় থেকে প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। গুগলের এমন সিদ্ধান্তের পর বিশ্বব্যাপী পাঁচ হাজার কর্মী নিয়ে কাজ করা মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার সারা বিশ্বে থাকা নিজেদের কর্মীদের ঘরে বসেই অফিসের কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। করোনার কারণে ছুটে চলা মানুষ বন্দী হয়ে পড়েছেন ঘরের চার দেয়ালের মাঝে। গতানুগতিক জীবনে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন, যা মানুষ নিজের চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ রখেছিল এত দিন। এক সময় স্বপ্ন বলে ভাবা পন্থাগুলো সময়ের হাত বদলে বাস্তব হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঘরে বসে অফিস করলে ১৬.৮ ভাগ বেশি কাজ করতে পারছে মানুষ। বছরে সামগ্রিকভাবে এ কাজের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে এখন এটা নিয়ে অনেকেই মনে করছেনÑ বিশ্বের প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্তে স্থায়ীভাবে চলে আসতে পারে। আবার দেখা গেছে, বাসায় বসে অফিসের কাজ করলে মানুষের জীবনযাত্রাও অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। মানসিক দিক থেকেও অনেকখানি ভালো থাকতে পারবে মানুষ।
বাড়বে বেকারত্ব
করোনার কারণে পুরো বিশ্বে নেমে এসেছে অর্থনৈতিক ধস। প্রতিনিয়তই দেশে দেশে বাতিল হচ্ছে কলকারখানার অর্ডার। সবকিছু কবে স্বাভাবিক হবে সে বিষয়ে কেউ কিছু জানে না। করোনা-পরবর্তী সময়ে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুনভাবে শুরু করতে পারলেও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে চিরতরে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়বে মানুষ। উৎপাদন না হলে, বিক্রি হবে না। মানে লাভ হবে না। যার অর্থ, কর্মী নিয়োগ হবে না। ব্যবসাগুলো স্বল্প সময়ের জন্য অনাবশ্যক কর্মীদের ধরে রাখে এ আশায় যে, পরিস্থিতি ফিরে এলে যাতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি বেশি খারাপের দিকে এগোলে তারা আর কর্মীদের ধরে রাখে না। মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে থাকে। ফলে তারা পণ্য কেনেও কম। আর পুরো চক্র নতুন করে শুরু হয়। আমরা এগোতে থাকি অর্থনৈতিক মন্দার দিকে। এখন পুরো বিশ্ব সেদিকেই যাচ্ছে। ফলে রোবট নিয়োগ বৃদ্ধি পেতে পারে কলকারখানাগুলোয়। এতে চাকরি হারাবে কোটি কোটি মানুষ। করোনা প্রাদুর্ভাবের ফলে যে বেকারত্ব তৈরি হবে, এতে কত লোক যে বেকার হবে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।
বাড়বে সচেতনতা, কমবে অর্থহীন কাজ
মানুষ নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে জীবনধারণ করতে পারে না। তাকে নানা রকম বৈচিত্র্যময় কাজ করতে হয়। এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ অর্থহীন কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতির করুণ অবস্থার একাংশের জন্য দায়ী এসব কাজ। এ মহামারী বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, অনেক কাজের কোনো দরকার নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। যে সমাজে অর্থনীতির মূল নীতিমালা হচ্ছে বিনিময়মূল্য। যেখানে জীবনযাপনের মৌলিক প্রয়োজন বাজারেই পাওয়া যায় সেখানে মানুষ অর্থহীন কাজ করতে আকর্ষণ বোধ করে। কিন্তু ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের পর মানুষ এসব কাজ থেকে দূরে সরে আসবে। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আসছে পরিবর্তন। ইউভাল নোয়াহ হারারি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে বলেছেন, যে জিনিস দরকার তা হচ্ছে ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক চুক্তি। মাসের পর মাস আন্তর্জাতিক ভ্রমণসূচি বাতিল করে দিলে কঠিন একটি অবস্থা তৈরি হবে। জরুরি কাজে ভ্রমণার্থী যেমন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের জন্য দেশগুলোর দরকার একে অপরকে সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে ভ্রমণার্থীদের প্রথমেই নিজেদের দেশে প্রি-স্ক্রিনিং করে ছাড়পত্র দেওয়ার পর গন্তব্যের দেশটি অনুমতি দেবে, এ শর্তে খুব সহজেই দেশগুলো একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারে। খুব সাবধানে এবং যতœ নিয়ে স্ক্রিনিং করার পর ছাড়পত্র পাওয়া একজন ভ্রমণার্থীকে আরেকটি দেশ সাদরেই গ্রহণ করতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট হবে দীর্ঘমেয়াদি
ওইসিডি-প্রধান বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, বিশ্ব অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। ওইসিডির মহাপরিচালক এঞ্জেল গুরিয়া বলেছেন, এ মহামারী থেকে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে তার থেকে বেশি বড় হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এর আকস্মিকতা। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ওইসিডি সরকারগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে তারা যেন তাদের ব্যয়নীতি ভুলে গিয়ে দ্রুত ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং ভাইরাসের চিকিৎসার পেছনে মনোযোগ দেয়। করোনাভাইরাস গুরুতর আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেকে কমে তা ১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে স¤প্রতি যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, গুরিয়া বলেছেন তা এখন খুবই আশাবাদী একটা পূর্বাভাস বলেই মনে হচ্ছে। মি. গুরিয়া বলেছেন, কত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন এবং কোম্পানিগুলোর কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।